গল্প: তুমি রবে নীরবে

রাতের বেলা টুসির সাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে রূপালী রং এর মস্ত বড় থালার মত চাঁদ। চাঁদের একপাশে একটা তারা আছে। আর কোন তারা নেই আকাশে। মানুষ মারা গেলে নাকি দূর আকাশের তারা হয়ে তার কাছের জনকে দেখা দেয়।

হঠাৎ করে আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। শুরু হলো চাঁদ ও মেঘের লুকোচুরি খেলা। চাঁদটা আস্তে আস্তে মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। হু হু শব্দ করে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে সেই সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ঝড় হওয়ার আগে যেমনটা হয় ঠিক সেরকম পরিস্থিতি মনে হচ্ছে। হঠাৎ ই বিদ্যুৎ চমকে উঠলো সেইসাথে অনেক জোরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেলো। ভয়ে টুসি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমি টুসির কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একেঁ তাকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বাইরে প্রবল বেগে বর্ষন, ক্ষনে ক্ষনে বজ্রপাতের শব্দ। আর ঘরে চলছে আমাদের আদিমতার লীলাখেলা। আমি টুসির মধ্যে ডুবে যেতে চাচ্ছি। টুসি আমাকে কোন প্রকার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেনা।

 পরেরদিন সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙলো দেখি টুসি আমার পাশে নেই। সে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে তার ভেজা চুলগুলো আচড়াচ্ছে। আয়নায় তার দেহাবয়ব ফুটে উঠেছে। কাজল কালো চোখ, গোলাপি ঠোঁটে রক্তিম আভা, নীলাভ সবুজ রং এর শাড়ীতে তাকে অপরূপ লাগছে। আমি বিছানা থেকে উঠে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেজা চুলের ঘ্রান নিলাম। চুল গুলো সরিয়ে তার ঘাড়ে একটা ভালোবাসার পরশ একে দিলাম। সে একটু কেঁপে উঠলো। তারপর আমার দিকে ঘুরে বসে বলল, "সকাল সকাল দুষ্টামি করোনাতো।"

"সকাল হোক বা বিকাল হোক তোমার সাথে দুষ্টামি না করলেতো আমার ভালো লাগেনা।"

"যাও ফ্রেস হয়ে আসো। আমি নাস্তা দিচ্ছি", বলে সে উঠে যেতে লাগলো। আমি পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরে তাকে বসালাম। ড্রেসিংটেবিল এর উপরে রাখা চুড়ির গোছা থেকে নীল রঙের একমুঠো চুড়ি নিয়ে তার হাতে পরালাম।

কিছুক্ষন তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। লজ্জায় সে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। আমি তার থুতনি ধরে মুখ উপরে তুললাম। মনে হলো কি যেনো একটা মিসিং। কপালে টিপ পড়া হয়নি। আমি বললাম, "তোমার টিপের পাতা কোথায়?"

"ড্রয়ারের মধ্যে আছে।"

 ড্রয়ার খুলে টিপের পাতা বের করে কপালের মাঝ বরাবর একটা কালো টিপ পড়িয়ে দিলাম। তার কাঁধে হাত রেখে কিছুক্ষন তার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার ঠোঁটের রক্তিম আভা নিজের ঠোঁটে মেখে নিলাম। মুহূর্তেই তার গালদুটো রক্তবর্ণ ধারন করলো। সে লজ্জায় আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকালো। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে রেখে বললাম, "এই আমার দিকে মুখ তুলে তাকাও।""

পারবো না।"

"কেন গো?"

"বুঝনা। আমার লজ্জা লাগে।"

"এতো লজ্জা কেন তোমার?"

"জানিনা।"

"ওরে, আমার লজ্জাবতী। তোমাকে তো আগেই বলেছি আমার কাছে কোন লজ্জা নাই।"

হ্যা বলেছ।

"তাহলে এখন আর মুখ লুকিয়ে থেকো না।

এই কথা বলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সে মাথা নিচু করে বসে রইলো। আমি ফ্রেস হতে চলে গেলাম। 

এই মেয়েটা কেনো যে এতো লজ্জা পায় তা আমি বুঝিনা। আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ছয়মাস হবে। কিন্তু তার লজ্জা পাওয়ার ধরন দেখে মনে হয় বিয়ের এক সপ্তাহ ও পার হয়নি। এতো লাজুক স্বভাবের যে কিছু হলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে মুখ লুকিয়ে ফেলে। কখনোও কোনো কিছু লজ্জায় বলতেও পারেনা। তবে তার ভাগ্যভালো আমি তার না বলা কথাগুলো বুঝে নিতে পারি।

ফ্রেস হয়ে এসে দেখি টেবিলে নাস্তা রেডী। দুজনে একসাথে বসে খেয়ে নিলাম। তারপর রেডী হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বিয়ের পর থেকেই অফিসে আসলে কাজের মধ্যে শুধু টুসির কথাই মনে পড়ে। তাই কাজের ফাঁকে ফোন দিয়ে তার সাথে কথা বলি। মাঝেমধ্যে কাজ ফেলেই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাই। তারপর তাকে নিয়ে রিকশা দিয়ে ঘুরে বেড়াই, ফুচকা খাই, কখনোবা সিনেমা দেখতে যাই। 

আজও অফিসে আসার পর থেকেই প্রতিদিনের মত টুসির কাছে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে। কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার সুযোগ নেই। কারন আজকে অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে। তাই প্রতিদিনের মত দুপুরে কাজের ফাঁকে তাকে ফোন দিলাম। কিন্তু ফোন রিসিভ করছেনা টুসি। এমনতো কখনও হয়না। তাকে ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই তো ফোন রিসিভ করে। কি করছে কে জানে! হয়তবা ব্যস্ত হবে। আবারও কাজে মনোযোগ দিলাম। ভাবলাম ও ফ্রি হয়ে ফোন দিবে। কিন্তু দিলোনা। তাই মিটিং এ যাওয়ার আগে আবার ফোন দিলাম। কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরও যখন টুসি ফোন ধরছিলোনা তখন টেনশন আরো বেড়ে গেলো। টুসির কিছু হয়নিতো। নাহ, আমি এ কি রকম নেগেটিভ চিন্তা করছি। এমন ও তো হতে পারে ওর ফোন সাইলেন্ট অবস্থায় ঘরের কোথাও পড়ে আছে হয়তো। মিটিংটা কোনমতে এটেন্ড করে বের হয়েই অফিসের সামনের ফুলের দোকানে গেলাম। প্রতিদিনই ফেরার সময় তার জন্য একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে যাই। গোলাপ পেলে খুশিতে আমার লজ্জাবতীটা একটা মিষ্টি হাসি দেয়। তারপর ফুলগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রাখে। ফুল কিনে একটা ট্যাক্সি নিয়ে দ্রুত বাসার দিকে ছুটলাম। হঠাৎ পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। আমি ভাবলাম টুসি ফোন দিয়েছে। পকেট থেকে বের করে দেখি পাশের বাসার রহিম চাচার ফোন। চাচা হঠাৎ কেন ফোন দিলো তা ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করলাম। 

"আসসালামুআলাইকুম চাচা।"

"অলাইকুমআসসালাম। বাবা, তুমি এই মুহূর্তে সিটি হসপিটালে চলে আসো।"

"কেন চাচা? কি হয়েছে? টুসির কি কিছু হয়েছে?"

"তুমি তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসো। আসলে সব কিছুই জানতে পারবে।"

এই বলে তিনি ফোন কেটে দিলেন। আমি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে হসপিটালের দিকে যেতে বললাম। হসপিটালে যাওয়ার পর দেখলাম বাসার আশেপাশের অনেকেই সেখানে। আমি চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, "টুসি কোথায়?"

চাচা আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি একটা একটা স্ট্রেচারে সাদা কাপড় মুড়িয়ে কাউকে রাখা হয়েছে। একজন লোক কাপড়টা সরিয়ে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার টুসির এই অবস্থা। হাতের থেকে গোলাপগুলো পড়ে গেলো। একটা চিৎকার দিয়ে বসে পড়লাম। কিভাবে হলো এরকম? আজ সকালেও তো একদম ঠিক ছিলো। আর এখন আমাকে একা করে দিয়ে সে চলে গেলো। আর কিছুই ভাবতে পারছিনা। আমার মাথাটা ঘুরাচ্ছে। আমি সম্ভবত জ্ঞান হারাচ্ছি।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমার জ্ঞান ফিরলো। বাসায় অনেক মানুষ, গ্রাম থেকে আমার মা, বাবা, বোন, টুসিদের বাড়ির সবাই এসেছে। সবাই খুব কান্নাকাটি করছে। কিন্তু আমি এখন পাথরের মত বসে আছি। 

প্রতিদিনের মত টুসি ছাদে কাপড় শুকাতে গিয়েছিলো। রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারনে ছাদ পিচ্ছিল ছিলো। জায়গায় জায়গায় পানি জমে ছিলো। ছাদের রেলিং না থাকার ফলে টুসি পা পিছলে পড়ে যায়। মাথায় আঘাত পেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরন হওয়ায় টুসি মারা গেছে।

 টুসিকে গোছল দেয়া শেষে এখন জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানাজার নামাযে গেলাম। নামায শেষে তাকে কবর দিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

সবাই আমাকে অনেক সান্তনা দিয়ে যার যার বাসায় ফিরে যাচ্ছে। মা, বাবা, বোন থেকে গেলেন।

আজ ও গত দিনের মত বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। তবে আমি একা রুমে। গত দিনের মত আমার ভালোবাসার মানুষটি পাশে নেই। আজকের আকাশে কোনো চাঁদ - তারা কিছুই নেই কিন্তু আকাশ মেঘলা। দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। হঠাৎই দমকা হাওয়া বইতে শুরু করলো। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে ছাদে গেলাম। গিয়ে দেখি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আমি ভিজতে থাকলাম, সেই সাথে লোতক বিন্দু ঝরতে লাগলো। ধীর পায়ে ছাদের কিনারায় এগিয়ে যাচ্ছি। টুসি তোমাকে ঐ দূর না ফেরার দেশে একা থাকতে হবে না। আমি আসছি তোমার কাছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post