গল্প- যোদ্ধা নানাভাই

অনেকদিন পর নানু আমদের বাড়িতে ঘুরতে এলো। বেশ। বাসার সবাই খুশি। সারাদিন কীভাবে কীভাবে কেটে গেলো জানি না। 

 সন্ধ্যায় আম্মু রান্না ঘরে ব্যাস্ত। আপু বড় রুমে টিভি দেখছে। আব্বু অফিস থেকে বিকেলে একবার বাসায় এসেছিলো তারপর আবার বের হয়েছে। সন্ধ্যার অনেক পরেই আব্বু বাড়ি ফিরবে। তার কলিগদের সাথে চা নাস্তা করে ক্যান্টিনে। নানু আমার রুমে শুয়ে আছে আর আমি পড়ছি।

 হঠাৎ করে নানু কে জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা নানু তোমরা তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিলে তাই না?"

 "হ্যাঁ, দেখছি তো।"

 "কি কি দেখছো তখন তোমরা?"

 "অইভাবে যুদ্ধ তো দেখি নাই কিছু। কিন্তু মিলিটারি দেখছি। জিপ গাড়ি দেখছি। বন্দুকও দেখছি। আরে আমগো ঘরের পিছন দিয়াই তো জিপ গাড়ি কইরা মিলিটারিরা বন্ধুক দিয়া ঠাও ঠাও কইরা গুলি ছুটাইতে ছুটাইতে গেছিলো।"

 আমি অবাক হলাম। নানু বাড়ির ঘরের পিছন দিয়ে গিয়েছিলো জিপ গাড়ি! নানু বাড়ির ঘর এর পিছে একটি ছোট পুকুর। তার চাষ করার ক্ষেত। সেখান থেকে একটি রাস্তা যায় সোজা গ্রামে ঢোকার আর বের হবার। তাহলে সেখান থেকেই জিপ গাড়ি এসেছিলো।

 আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, " তখন তোমরা কি করেছিলে?"

 " তখন আমার বিয়া হইছে। তখন তোর মা খালারা কেউ হয় নাই৷ শ্বশুর শ্বাশুড়ি, জামাই আর দেবর নিয়া সংসার। আমগোর এখন পাকা বাড়ি। কিন্তু আগে তো ছিলো টিনের বেড়া আর মাটির ভিটে। তখন ঘরের ভেতরে মাটিতে অনেক গর্ত খুড়েছিলাম। যখনই শুনেছিলাম মিলিটারি আইতাছে তখনই গর্তে ঢুইয়া শুইয়া থাকতাম আমরা। গুলি ছুড়তো। মেলা শব্দ হইতোম টিন ফুটা কইরা ইসপার অস্পার বুলেট যাইতো। ভয়ে কাপতাম।" 

 আমি বললাম,"অনেক ভয়ে দিন কেটেছিলো তোমাদের তাইনা?"

 "হ,নানু তা কাটছিলো। সবচেয়ে বড় ভয় পাইছিলাম যখন তোমার নানারে ধইরা নিয়া গেছিলো।" 

 "কি বলো নানু? নানাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো?"


 আমার নানা গেলো বছর মারা গিয়েছে। নানুর কাছে এ কথা শুনায় নানার চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো!

 নানু বললো, "হ,তোমার নানা রে ধইরা নিছিলো!" 

 "পরে? নানা ফিরে এসেছিলো কীভাবে? ধরেছিলো কীভাবে? কেনই বা ধরেছিলো?" 

 "তখন তো যারে তারে ধইরা নিয়া যাইতো! কারণে অকারণে ধইরা নিয়া যায়। শুনছিলাম ধইরা নাইরা ফেলায়! তোমার নানারে ধরার পর আমি ভয়ে কাননা জুইড়া দিছিলাম। তোমার নানা রে বাড়ি থেইকা আইসা তুইলা নিয়া গেছিলো মিলিটারি। নিয়া পাশের গ্রামের এক নাকি জমিদার বাড়িতে রাখছিলো। মানে রাজাকার বাড়িতে।"

 "তারপর তারপর?"

 "তারপর বিকেলের দিকে দেখি তোমার নায়া ফিরা আইছে। আত্মায় পানি আছিলো না সারাদিন। তারে দেইখা শান্তি পাইলাম। শ্বাশুড়িও কান্না থামাইছে। তারে আমরা দুজোনে মিলা যত্ন করতে লাগছিলাম। কেউ পানি খাওয়াই,তো কেউ মাতায় পানি ঢালি। সেও ভয় পাইছিলো।" আমি বললাম, "যাক, কিন্তু নানা ফিরে আসলো কীভাবে? মিলিটারিয়া ছেড়ে দিলো কেনো? ছেড়ে যখন নিবে ধরে নিলো কেন?" নানু বললো, "পরে তোমার নানা শান্ত হবার পর তার কাছে শুনলাম। সে নাকি অই বাড়িতে গিয়ে ভয়ে কান্না শুরু করেছিলো। তখন নাকি অই বাড়িতে এক মেয়েমানুষ সবাইকে রেধে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলো। তোমার নানার কান্না দেখে সে কাছে আসলো, তখন নাকি তোমার নানা কইছিলো যে তার নাকি তার ছেলে হইছে। তার কিছু হয়ে গেলে ছেলে না খেয়ে মরবে। এটা শুনে নাকি অই মাইয়াডার  মন গইলা গেছিলো। সে নাকি মিলিটারিগোর কইয়া তৎক্ষনাৎ ছাউড়া দিছিলো।" 

 এটা শুনে আমি শান্ত হলাম। হয়তো অই মহিলা অনেক বড় কেউ ছিলো যার জন্যে নানাভাই ছাড়া পেয়েছিলো। আম্মুর মুখে অনেক শুনেছিলাম নানা পুলিশ অনেক ভয় পায়। নানুকে এটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম এই ব্যাপারে।

 নানু বললো, "হ তারপর থেইকাই। অইখান থেইকা ছাড়া পাওয়ার পর তোমার নানা অই বাড়ির খবর নাকি মুক্তিবাহিনীর ছেলেপেলেগোর দিছিলো। তারপর নাকি অই বাড়িতে আক্রমণ হইছিলো।"

 এটা শুনে আমার লোম যেন দাঁড়িয়ে গেলো। বুকের মধ্যে এক অনুভুতি পেলাম।


 অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের। আমার চোখে আমার নানাভাইও এখন এক যোদ্ধা।

Post a Comment

Previous Post Next Post