গল্প: পুনরাবৃত্তি

 "যমদূতের সাথে আমার যখন প্রথম দেখা হয়েছিলো তখন আমি তাকে বলেছিলাম, 'আমাকে এখনি তোমার সাথে নিয়ে যাও।' সে বলল, 'এখন না, সময় হলেই আমি তোমাকে নিতে আসব।'

ছোটবেলা থেকেই আমি অসুস্থ। আমার ব্রেনে একটা টিউমার হয়েছে যেটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ডাক্তার বলেছেন, 'ঔষুধের মাধ্যমে টিউমার বড় হওয়া বন্ধ না হলে অপারেশন করাতে হবে। নয়তো এটা ফেটে গিয়ে আপনার মৃত্যু হবে।'

পৃথিবীতে আমার মা-বাবা কেউ বেঁচে না থাকায় এক সময় আমি অসুস্থ অবস্থায় খুব বেশী না ভুগে দ্রুত মরতে চাইতাম। এখন আপনি আমার সাথে আছেন বলে আমি আর মরতে চাই না। ভাবছি যমদূত আবার আসলে তার সাথে একটা চুক্তি করব মৃত্যু নিয়ে।"

"চুক্তির বিষয়বস্তু কী হবে?" আদীব জিজ্ঞেস করল

"এটা আপনাকে বলা যাবে না। আমার আর তার মধ্যকার ব্যাপার এটা।"

"ফারিন, তুমি কি সত্যিই যমদূত দেখেছ!"

"কেন? আপনার আমার কথা বিশ্বাস হয় না?"

"বিশ্বাস হবে না কেন?"

"তাহলে এভাবে অবাক হচ্ছেন কেন?"

"না মানে আমি কখনও যমদূত দেখিনি তাই।"

"যাদের তাড়াতাড়ি মৃত্যু হবে তাদের সাথেই যমদূত দেখা করে। আপনার মৃত্যু হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে আপনারও তার সাথে দেখা হবে।"


চার বছর পরের ঘটনা।

 সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফেরার সময় বাসার কাছাকাছি গলির মুখে ঢুকতেই কালো পোষাক পরা এক লোকের সাথে আদীবের দেখা হলো। লোকটা তার সামনে এসে পথ আটকিয়ে বিকট শব্দ করে হাসতে থাকে আর তার কালো পোষাকের নিচের অংশে আগুন জ্বলা শুরু করে।

এসব দেখে আদীব ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,"আপনি কে?আমার পথ আটকেছেন কেন? কী চাই আপনার?"

লোকটা হাসি থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

"আমি যমদূত। ফারিনকে নিতে এসেছি। কিন্তু সে যেতে চায় না। তাই তোমার সাহায্য প্রয়োজন।"

"কী বলছেন এসব! যমদূত! ফারিনকে নিতে এসেছেন! এসবের মানে কী?"

"সে তোমাকে আমার কথা বলেছে নিশ্চয়। তোমার সাথে সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর আমি তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। তখন সে বেঁচে থাকার জন্য আমার কাছে সময় ভিক্ষা চেয়েছিল। তুমি নিশ্চয়ই জানো তাকে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে তার সাথে আমার একটা চুক্তি হয়েছে।"

যমদূতের কথা শুনে তার মনে পড়ল, প্রায় চার বছর আগে ফারিনের বলা কথাগুলো সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। 

"হ্যা চুক্তির ব্যাপারে আমি কিছু একটা শুনেছিলাম। আপনার সাথে তার কী চুক্তি হয়েছিল?"

 "তুমি ফারিনকে যতদিন ভালোবাসবে ততদিন সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারবে। তার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সময় আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী আছে। তাই আমি চাচ্ছি তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে। যদি তুমি এই পরীক্ষায় আজ উর্ত্তীন হও তাহলে আমি তাকে নিয়ে যেতে পারব না।"

"শুনি, কী পরীক্ষা? আর আপনি যে যমদূত সেটা আমি বিশ্বাস করব কেন?" 

"আজ রাতে বাসায় ফিরে তুমি কোনো ব্যাপারে তার মতামতের বিরুদ্ধে যাবে না। যদি যাও তাহলে আমি তাকে আমার সাথে নিয়ে যাব।" এই কথা বলেই মুহূর্তের মধ্যে লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে হাওয়া হয়ে যেতে দেখে মনে ভয় নিয়ে আদীব বাকি রাস্তা দৌড়ে বাসায় পৌঁছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চার-পাঁচ বার কলিংবেল বাজানোর পরেও যখন ভেতর থেকে দরজা খুলল না তখন সে তার কাছে থাকা ডুপলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখে ফারিন মেঝেতে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে আদীব তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে ডাক্তাররা তাকে এম আর আই টেস্ট করেন। 

একজন ডাক্তার এসে আদীবকে বলে, "এমআরআই টেস্টের রেজাল্টে জানা গেছে রোগীর ব্রেন টিউমারটা আগের চেয়ে দ্বিগুন বড় হয়ে গেছে। এখন যেভাবেই হোক দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো টিউমার ফেটে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।" 

ডাক্তারের কথা শোনার পর সে ফারিনকে দেখার জন্য কেবিনে প্রবেশ করে। 

ফারিন আদীবকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, "ডাক্তার কী বলেছেন ?"

"তেমন কিছু না।"

"তাহলে তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? তুমি তো জানোই আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারি তোমার মনের ভেতর কী চলছে। কী হয়েছে বলবেনা আমাকে?"

"তোমার টিউমার অপারেশন করতে হবে।"

" না। আমি চাই না অপারেশন করা হোক।"

"অপারেশন না করলে ঐটা ফেটে গিয়ে তোমার মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা আছে।" 

"আমার অপারেশন করতে গেলে যদি কিছু হয়ে যায় তখন?" 

ফারিনের প্রশ্ন শুনে আদীব শুকনো হাসি দিয়ে বলল, "তোমার কিছুই হবে না। তুমি বাঁচবে। যেভাবেই হোক তোমাকে বাঁচাবো।"

"তাহলে যাও ডাক্তারকে বলো আমাকে নতুন কোনো কড়া পাওয়ারের ঔষুধ দিতে যেটা খেলে আমি অপারেশন ছাড়াই ভালো হয়ে যাব।"

"তুমি অপারেশন করাতে এখনও রাজী নও?"

" হ্যাঁ। আমার তোমার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে আর ভালো লাগছে না। মাথাটা আবারও ব্যাথা করছে," এই বলে ফারিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।

রুম থেকে বেরিয়ে হেটে লম্বা করিডোর পার হয়ে আদীব ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগেই দেখতে পেল ডাক্তার নার্সরা দৌড়ে ফারিনের রুমের দিকে যাচ্ছে।‌ সে তাদের পিছনে ছুটলো। তাকে রুমে ঢুকতে দেয়া হলো না। মিনিট দশেক পরে একজন ডাক্তার বের হয়ে বললেন, "সরি, শী ইজ নো মোর।" 

এই কথা শোনার পর আদীব দাড়ানো অবস্থা থেকে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।


কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আদীব রাস্তার পাশ দিয়ে দৌড়াচ্ছে। তার মনে পড়ছে সেই কালো পোশাক পরিহিত লোকটার কথা যে বলেছিল ফারিনের মতের বিরুদ্ধে গেলেই ফারিনকে নিয়ে যাবে। তার সাথে অপারেশনের কথা বলেই আদীব ভুল করেছে।

এক সময় সে একটা নদীর পাড়ে গিয়ে থামল। কালো ঘোলাটে পানির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আদীব নদীতে ঝাঁপ দেয়। 

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যমদূতটা এই দৃশ্য দেখে আর বলে, "এখনও তোমার মৃত্যুর সময় হয়নি। আরও অনেক বছর তোমার মৃত স্ত্রীর স্মৃতি নিয়ে তোমাকে বাঁচতে হবে।"


"এই তাড়াতাড়ি উঠো, না হলে তোমার অফিসে দেরী হয়ে যাবে।" 

পরিচিত গলার স্বর শুনে আদীব চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা থেকে নেমে দেখে ফারিন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার মনে হয়, সে স্বপ্ন দেখছে। 

"এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? মনে হচ্ছে যেন ভূত দেখতে পেয়েছ," বলেই ফারিন তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়।

আদীব বিড়বিড় করে বলে, "তাহলে এতক্ষণ আমাদের সাথে যা ঘটেছে সবই বোধ হয় আমার স্বপ্ন ছিল।"

"কী বললে তুমি? বুঝলাম না।"

"না। কিছু না। আজ কত তারিখ?"

" উনিশ তারিখ।"

"গতকালই তো উনিশ তারিখ গেল!"

"এই যে আজ উনিশ তারিখ," বলেই ফারিন দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়।

"১৯-৯-২০১৯, ১৯-৯-২০১৯" বিড়বিড় করে আদীব বলতে থাকে।

"যাও, তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য রেডী হয়ে নাও। দেরী হয়ে যাবে। আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি।" বলেই ফারিন রান্নাঘরের দিকে যায়।


গতকালকের মত অফিসে একটা সাধারন দিন পার করে আদীব। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার সময় বাড়ির কাছাকাছি গলির সামনে কালো আলখেল্লা পরা একজন তার পথ আটকায়। সে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে, এই লোককে আগে কোথায় যেনো দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারছে না। 

 "তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী আছে। যত চেষ্টাই করো না কেন তাকে বাঁচাতে পারবে না তুমি," বলেই লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

এই কথা শুনে তার আগের দিনের কথা মনে হয়। সে দৌড়ে বাসায় গিয়ে কলিং বেল না বাজিয়ে ডুপলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখে ফারিন মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।

তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে আগের দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। এবার আদীব ফারিনের রুমে গিয়ে তার অপারেশন করতে হবে সেই কথা বলে না। বরং ডাক্তারকে বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফারিনের অপারেশনের ব্যবস্থা করতে। 

অপারেশন থিয়েটারে ফারিনকে নেয়ার আগে তাকে জড়িয়ে ধরে আদীব বলে, "চিন্তা কর না। তুমি সুস্থ হয়ে ফিরবে।"

ফারিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, "আমি না ফেরার দেশে চলে গেলে মন খারাপ করে থেকো না।"


প্রায় দুই ঘন্টা পরে একজন ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এসে আদীবকে বলে, "উই ট্রাই আওয়ার বেস্ট, বাট শী ইজ নো মোর।"

 ফারিনের মৃত্যুর সংবাদ শুনেই সে হসপিটাল থেকে দৌড়ে বের হয়ে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে সে একটা চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গাড়িটা তার শরীরের সাথে লাগার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন তাকে টেনে ধরে সরিয়ে নিয়ে যায়।


আবারও সে কালো পোষাক পরা লোকটার মুখোমুখি। 

"আপনি আমাকে বাঁচালেন কেন?"

"তোমার মৃত্যুর সময় আসেনি এখনো। তুমি যদি এখন মারা যেতে তাহলে আরো একবার তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর স্বাক্ষী হতে।"

"আর একবার সুযোগ পেলে আমি ঠিকই আমার স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম।"

"ভুল। তুমি যতবারই ১৯-০৯-২০১৯ তারিখে ফিরে যেতে ঠিক ততবারই ফারিনের মৃত্যু হতো। কারন এই তারিখটা তার মৃত্যুর দিন হিসেবে আগেই নির্ধারিত করা হয়ে গেছে। এরই মধ্যে তোমার কারনে সে একবারের জায়গা দুইবার মৃত্যুকালীন যন্ত্রনা ভোগ করেছে। যাও, হাসপসতালে ফিরে গিয়ে তার মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করো।" 

যমদূতের কথায় আদীব হাসপাতালের দিকে ফিরে যেতে থাকে। তাকে ফিরে যেতে দেখে যমদূত ধীরে ধীরে বাতাসের সাথে মিশে যায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post