অনেকদিন ধরে
মশকরা চাচার কাছে চা খেতে যাই না। সময় কোথায়। আজকে বিকেলে কোনো কাজ নেই। তার উপর আজ
মেঘলা দিন। আকাশা কালো মেঘের ভেলা উড়ে বেড়াচ্ছে। আজ মশকরা চাচার কাছে যাওয়ার উপযুক্ত
সময়ও বটে। যদিও তার কোনো কথাই মোটেই সত্য নয়; হতে আরে না। তবে তিনি জানেন কীভাবে গল্প
বলতে হয়। তার গল্প যতক্ষণ শুনি ততক্ষণ মগ্ন থাকি । হারিয়ে থাকি তার গল্পে। তার উপর আজকে মেঘলা দিন। আষাঢ়ে গল্প জমবে ভালো।
রুহানের সাথে ফোনে আলাপ করে বের হলাম। হাটতে হাটতে
চলে গেলাম মশকরা চাচার ভ্যানের সামনে। রুহান
আজকে লম্বা করে একটা সালাম দিলো মশকরা চাচাকে।
“আসলালামু
আলাইকুম চাচা”
রুহানের সালাম
শুনে চাচার ভ্যানের সামনে বসে থাকা লোকটি ঊথে গেলো চাচাকে পাওনা পরিশোধ করে।যাক ভালোই
হল। আপনারা যদি ভাবেন আমরা অসামাজিক তাহলে ভাবতে পারেন, আসলে আমাদের অপরিচিত লোকদের
সামনে বা সাথে বসে চাচার কাছে গল্প শুনতে ভাল্লাগে না। তারা ভাবতেও পারে কতো বড়ো হয়েও
কিসব আজে বাজে ভুতের গল্প শুনতে বসেছে।
চাচা সালামের
উত্তর দিয়ে হাসলো। লোকটি চলে যাওয়াতে ভালই
হয়েছে। তিনি চা আনাতে শুরু করলেন। এখন আর বলতেও
হয় না চাচাকে আমরা কী চা খাই।আমার জন্যে দুধ চা, রুহানের জন্যে রং চা। চাচা আমাদের এখন চিনে রেখেছে। তার সাথে খাতিরও ভালোই
হয়েছে।
আমি বললাম,
“চাচা, মেঘলা দিন । একটা গল্প হবে নাকি?”
তিনি মুচকি
হাসি দিলেন। তিনি মনেহয় জানে এই আবদার করা হবেই। তিনি বললেন, “হ্যাঁ, হবে।“
তিনি তিন
কাপ চা বানালেন। দুই আমার আর রুহানের জন্যে। আর এক কাপ তার নিজের জন্যে। একটা জিনিস
লক্ষ্য করেছি যে তিনি গল্প বলার সময় চা খান। চা ছাড়া কখনো তাকে গল্প বলতে দেখেনি, চা
এমন একটা জিনিস যেটা গল্প বলতে আর গল্প শুনতে ,সবসময়ই সাথে চাই।
চাচা একটু
গলা পরিষ্কার করলেন। বুঝলাম গল্প বের হচ্ছে। তার গল্পগুলো যেনো তার মগজ থেকে না এসে
,আসে পেট থেকে।
তিনি বলা
শুরু করলেন।
“অনেকদিন
আগের কথা। তখনো আমি বিয়ে করিনি। গ্রামে থাকি। বিশ কি বাইশ বছর বয়স হবে তখন আমার। তখনও মন কোনো কিছুতেই স্থির থাকতে চায় না।
কোনো আইনেই যেনো মান্য করা নেই, কোনো কিছু
তেই যেনো ভয় নেই। সারাক্ষণ নিজের মনে যা আসে
তাই করতে মন চায়। দিন নেই রাত নেই যখন মন চাচ্ছে বাইরে যাচ্ছি আর ভেতরে আসছি। এমনও
সময় গিয়েছে যে বাড়ি থেকে বের হবার পর শুধু তিনবেলা খাওয়ার জন্যে বাড়ির মুখ দেখেছি।
বাবা ছিলো না। বড় দুটো ভাই ছিলো, তিন বোন ছিলো, তার মধ্যে দুই বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো।
বড় দুটো ভাই সংসারে মন দিয়ে ছিলো। ভালোই রোজগার করছিলো। ছোট বোনের বিয়ের সমস্যার সমাধানও
দুই ভাই করবে। এসব ভেবে আমার মা নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাই আমি কখন কি করি সেদিকে মন দিতেন
কম। তবে আর যাই হোক মা তো। প্রায়ই বুদ্ধি পয়ামর্শ দিতেন। আমার জনে স সময়ই খাবার গরম
করে রাখতেন, ফিরতে দেরী হল গরম কর দিতেন মা-ই। জানতাম কয়েকবছর পর কিছু করে খেতে হবে,
ভাইয়েরা আর কতোদিন চালাবে। তবে বেশি ভাবনা ছিলো না। না খেয়ে তো আর কেউ মরে না।
এভাবে আমার
দিন বেশ আনন্দেই যাচ্ছিলো। তারপর একদিন আমার বোনের বিয়ে ঠিক হলো। তখনি শুরু হলো এক
বিপত্তি। যার সাথে বিয়ে ঠিক হলো তাদের বাড়ি পাশের
গ্রামেই। আমি মনে মনে ঠিক করলাম অই গ্রামে গিয়ে অই ছেলের সম্পর্কে খোজ নিবো।
বাড়ির কাউকে কিছুই না বলে বেরিয়ে গেলাম।তখন গাড়ির ব্যবস্থা তেমন ছিলো না। হেটে যাওয়া
লাগবে। হাটতে হাটে অনেকদুর গিয়ে একটা গাছের নীচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। কিছুক্ষণ
পর আবার হাটা শুরু করলাম। আবার অনেকদুর হাটার পর খেয়াল করলাম আমি এর আগে যে গাছটার
নীচে বিশ্রাম নিয়েছিলাম সে গাছটিই আবার আমার পথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বট গাছ। তোমরা
হয়তো ভাবছো আরেকটা বটগাছ তো এ পথে আসতেই পারর তাতে অবাক হবার কী আছে? হ্যাঁ, অবাক হবার
কিছুই আছে। কারণ, আমি সেই কতো বছর কতো দিন
ঘুরাঘুরি করচি। এ পথে আগেও অনেকবার এসেছি,আমার স্পষত মোণে আছে এ পোঠে একটিই
বটগাছ পরে। আর আমি একটু আগে যে গাছের নীচে অসে বিশ্রাম নিয়েছি সে গাছ আরেকটুবাদে চিনবো
না।
আমরা তার
কথায় “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক “ বলে সাই দিলাম। তিনি থামলেন না।
মাথা আর ঘামালাম
না সে নিয়ে। আবার হাটা শুরু করলাম বিশ্রাম না নিয়েই। আবার হাটতে হাটতে অনেকক্ষণপর আবার
একই দৃশ্যের পুনরায় আবর্তন ঘটায় আমার মাথ ঘুরে পরে যাবার অবস্থা।নিজেকে সামলিয়ে গাছটার
নীচে নিজেকে নিয়ে গিয়ে বসে পড়লাম। বসে বসে ভাবতে লাগলাম আমার তো পথ গোলাবার কোনো কথা
নয়, সরু রাস্তা ধরে হাটলেই পাশের গ্রাম। একটা ছোট বাচ্চাও তো সোজা হেটে গেলেও পাশের
গ্রামে পৌঁছে যাবে। আর আমি এতোদিন বাইরে যখন খুশি ঘুরে বেড়াচ্ছি আর আমার পথ ভুল হচ্ছে।
পরের দিন
সকালে চোখ খুলে দেখি আমি বাড়ির বিছানায়। আমি চোখ খুলার পর মা এসে আমার মাথায় কান্না
জড়ানো চোখে আমার মাথায় হাত বুলালেন। তারর রাগি গলায় বললেন, “নেশা কয়া হচ্ছে? হ্যাঁ?
নেশা করে যেখানে খুশি শুয়ে থাকা হচ্ছে? শেষে এশে আমাকে এটা দেখতে হলো!”
মাকে আমি
তখন আস্বস্ত করলাম যে আমি নেশা করিনি।
মা যেনো আমাকে
বিশ্বাস করলেন।
তারপর আর
সারাদিন বিছানা ছেড়ে উঠিনি। শুনলাম আমাকে নাকি সেই বটগাছের নীচে জ্ঞান হারানো অবস্থায়
পাওয়া গিয়েছিলো।
তারপর সারাদিন
শুয়ে শুয়ে ভাবলাম এটা কেনো হলো? ধীরে ধীরে মোণে পড়লো পথ হারানোর কথা। আমার পথই বা কেনো
হারালো? প্রশ্নের উত্তর খুজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু দিন শেষে উত্তরপেলাম নিজের মগজ থেকেই।
এটা ছিলো কানাভুলোর কাজ ।“
তারপর রুহান
হঠাঠ স্কুলে হাত উচা করে স্যার বা ম্যাডামের বুঝানো কোনো কিছু বুঝলে প্রশ্ন করার মতো
করে মশকরা চাচা কে জিজ্ঞেস করলো, “চাচা, হেহে, ইইয়ে মানে…কানাভুলো কি জিনিস?”
মশকরা চাচা
হালকা বিরক্তি এবং হালকা হাসি মিশানো সুরে বললে, “কানাভুলো হলো এক শ্রেণির ভুত।এ শ্রেণীর ভূতেরা পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এবং অচেনা স্থানে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে মানুষ একই রাস্তায় বারবার ঘোরপাক খেতে থাকে। এই ভূতরা কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তার শিকারকে মেরে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে শিকার তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এধরনের ভূতদের রাতে গ্রামের মাঠের ধারে পথের মধ্যে দেখা যায়। শিকার দলে থাকলে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।“
রুহান অভিব্যাক্তি দিলো যে সে বুঝেছে।চাচা আবার শুরু করলেন।
“আমাকে দিয়ে শুরুর পর ধীরে ধীরে গ্রামের অনেকেই কানাভুলো শিকাড় হতে
লাগলো। কেউ কেউ আমার মতোই একই জায়গায় বারবার যেতে লাগলো,পরে সকালে তাকে অজ্ঞান অবস্থায়
পাওয়া গেলো। আবার কেউ কেউ এক গ্রামে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করার পর পৌঁছে দেখে সে
দুই গ্রাম পেরিয়ে এসেছে।
এতোতুকুই তেই সবাই বিরক্ত, মাত্রাতিরক্ত হলো তখন যখন পর পর দুই ঘরের
এক বুড়ো আর এক যুবক পথ হারিয়ে মারা পড়লো কানাভুলোর
হাতে।
আমার তখন মনমতোন ঘরের বাহিরে যায়া মায়ের নিষেধ। আমিও আর যায়নি, শুধু
যে মাকে ভালোবাসি বলে মায়ের আজ্ঞা পালন করেছিলাম তা না। দুটো মৃত্যুর পর আমার মনেও
ঢুকে গিয়েছিলো। তারপর গ্রামের লোকেরাও ভয় পেয়ে যায়। খুব দরকার না হলে দূরের রাস্তায়
পা দেয় না। এভাবে বছরখানেক কেটে যায়। গ্রামের এ অবস্থা দেখে বোনের বিয়েটা সে বছর আর
হয়নি। বছর শেষ হতে না হতেই অনেকদিন কানাভুলো আক্রমণ না হয়ার মানুষের মন থেকে কানাভুলোর
ক পর্যন্ত উঠে যায়। এটাই মানব মন। তারপর গ্রামবাসীরা আবার স্বাভাবিকভাবে
চলাফেরা শুরু করে। এর পর আর কানাভুলো আক্রমণ হয়নি।“
আজকের মতো গল্প এখানেই শেষ, মেঘ সরে গিয়েছে অনেক্ষন হলো। এবার লোক
আসতে শুরু করেছে চাচার দোকানে। একটা জিনিস খেয়াল করেছি বৃষ্টি বা মেঘ-বাদলের দিনে আমরা
কয়েকজন ছাড়া খুব একটা মানুষ আসে না চাচার দোকানে।
আজকের চায়ের বিলটা রুহানই দিলো। তারপর আমি আর রুহান কৃষি গবেষণার
গেইট দিয়ে ঢুকলাম,তারপর এখানে থেকে ধাণ গবেষণার গেইট দিয়ে ঢুকে বাসায় যাবো। আজকে গেইটের
আনসার আংকেল বললো আজকে কোন গল্প বানালো? বলেই নিজে হাসা শুরু করলো।
আমরাও মুচকি হাসলাম।